করোনা আক্রান্ত ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম

বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আক্রান্তের দিক থেকে ঢাকার পরেই নারায়ণগঞ্জের স্থান। ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনা। ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের একজন নারায়ণগঞ্জের ই-সেবা কেন্দ্রের সহকারী কমিশনার তানিয়া তাবাসসুম তমা। দায়িত্ব পালন অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হন তমা।

করোনা পজিটিভ আসার পর আইসোলেশনে চলে যান। গত ২০শে এপ্রিল রাতে আইসোলেশনে থেকে নিজের ফেসবুকে কোভিড-১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায় প্রশাসন শীর্ষক একটি স্ট্যাটাস দেন করোনায় আক্রান্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া।

তার সেই স্ট্যাটাস তুলে ধরা হলো:
কোভিড ১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায় প্রশাসন
করোনার ভয়াল থাবা এসে পড়তে দেরী নেই, সবাই প্রস্তুত হও সরকারের নির্দেশ। সরকারের কর্মচারী তাই পিছপা হবার সুযোগ নেই। দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধই প্রশাসনে চাকরির ধর্ম। অগত্যা ১ বছরের তাইফ আর ৩ বছরের নামিরাকে মায়ের কাছে ঢাকায় রেখে নারায়নগঞ্জে থাকতে শুরু করলাম। নিয়মিত অফিস, মোবাইল কোর্ট, গণসচেতনতা কার্যক্রম, জরুরী ত্রাণ কাজ, কন্ট্রোল রুম ডিউটি, প্রতিদিনের রিপোর্টসহ প্রেস ব্রিফিং তৈরি, বেসরকারি ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম যখন যেটা সামনে পড়েছে করেছি। ভাবছেন এতো বলছি কেন, এসব তো প্রশাসনের কাজই। হ্যাঁ, সেজন্যই ফটোসেশন, ফেসবুক পোস্ট বাহুল্য এড়িয়ে চলেছি। আমি খুব নিভৃতচারী তাই কাজকে প্রাধান্য দিয়েছি আগে।
Read More News

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী ছিলাম বলে জীবাণু নিয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা রাখি বলে দাবি করি। জীবাণু ভীতিটাও তাই সরিয়ে রেখে কাজ করতে পেরেছি বোধ হয়। সারাদিনের চেষ্টা ক্লান্তি শেষে যখন দেখতাম লোকজন কথা শুনছে না, একই ব্যক্তি নানা অজুহাতে ঘরের বাইরে আসছে, ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে ত্রাণ চাইছে আর প্রশাসনের সকল কাজ নিয়েই, যত দোষ নন্দঘোষ অপপ্রচার তখন শুধু নতুন উদ্যম হাতরে খুঁজে বেড়াতাম। কিন্তু খারাপ লাগা ঘিরে ধরত যখন ভিডিও কলে সন্তানের মুখ আর প্রিয় স্বরগুলো শুনতে পেতাম। নিজের চেয়ে বেশি ভাবতাম পরিবারকে নিয়ে। জানেন কতো রাতে ঘুমাতে পারিনি। শারীরিক মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বলও হয়ে পড়েছিলাম। তার মধ্যে সারা দেশে রি রি করে উঠলো প্রশাসন বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে জেলা প্রশাসন নাকি পিপিই চোর। অথচ ডিসি স্যার নিজ উদ্যোগে আমাদের সেটা যোগাড় করে দিয়েছিলেন। পরে যতো বেসরকারি পিপিই পাওয়া গিয়েছিলো চিকিৎসকসহ অন্য সবাইকে দেওয়া হয়েছিলো জনস্বার্থে। যাই হোক নূন্যতম নিরাপত্তাটুকু নিয়েই কাজ চালিয়ে গিয়েছি, সকল প্রশাসন যোদ্ধারাও সারাদেশে তাই করছে।

মুসলমান হিসেবে মৃত্যু ভয় মনে রাখিনি, প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রাণ বাঁচাতেই দৌঁড়ে বেড়িয়েছি। নিজ জেলা চাঁদপুর, কিন্তু কর্মস্থল দেশের সমৃদ্ধ একটি জেলা নারায়ণগঞ্জকে আজকে যখন লোকে বাংলাদেশের উহান বলছে তখন বুকটা মুচরে উঠে। আপনাদের সেবা করতে গিয়ে আজ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারি আক্রান্ত, ত্রাণ কাজের একজন পরিশ্রমী কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন । এখনও মনে পড়ছে শেষ যেদিন সন্ধ্যায় কাশিপুর, গোগনগর এলাকায় মোবাইল কোর্ট করছিলাম মাইকে চিৎকার করে বলছিলাম প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসী, এ জেলার অবস্থা আর কতো খারাপ হলে আপনারা সচেতন হবেন!

আজ আমি, আমার পরিবার (স্বামী ও মা) প্রশাসন পরিবার কোভিড ১৯ আক্রান্ত। আমাদের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ পাওয়ার পর আত্মীয়, বন্ধু বিশেষ করে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন আমাকে যেভাবে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আল্লাহ যেন দ্রুত আবার সুস্থ করে দেন, দেশের সেবা করার তৌফিক দেন। তাদের সকলের নাম বলতে গেলে তালিকাটি দীর্ঘ হয়ে পোস্টটি আরো বড় হয়ে যাবে। অসংখ্য ধন্যবাদ সকলকে। ভালো থাকুক নারায়ণগঞ্জ, ভালো থাকুক প্রিয় দেশ।

সবাই আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। সাধারন এ জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত পার করেছি। সন্তান দুটো জন্ম দিতে গিয়ে দু দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন ওদের ভাগ্যে। আবার যেন আমরা প্রিয় মুখগুলোর কাছে ফিরে যেতে পারি, আল্লাহ যেন সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখেন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *