ছাদে কাপড় মেলতে ৫ জন ‘সাহসী’ মহিলা আবশ্যক!

হ্যাঁ, এটি একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিই। ঘটনাও সঠিক। ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়ার জন্যই ৫ জন মহিলা নিয়োগ করা হবে।

অবাক হতেই পারেন এমন বিজ্ঞাপন দেখে। তবে শ্রেণীবদ্ধ এ বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশের পরই হাজারো প্রশ্নবাণে বিজ্ঞাপনদাতার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!‘

‘যাদবপুরে সাহসী পাঁচ জন মহিলা চাই। তিন তলার ছাদে কাপড় মেলার জন্য।’’ শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের কলামে এই আবেদন দেখেই বাঙালির তর সয়নি। তড়িঘড়ি তার ছবি তুলে ছড়িয়ে দিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে। ভাইরাল হতে আর কতক্ষণই বা লাগে? ‘ছাই উড়াইয়া’ দেখে ‘অমূল্য রতন’ পাওয়ার, থুড়ি, জানার আগ্রহ বড় কম নয়। তাদের ঠ্যালায় এখন ঘুম ওড়ার জোগাড় যাদবপুর সেন্ট্রাল রোডের বহুতলের বাসিন্দা ঝুমা ঘোষের। বিজ্ঞাপনটা তিনিই দিয়েছিলেন যে!
Read More News

সপ্তাহখানেক আগে বিজ্ঞাপনটি বেরোনোর পর থেকে একের পর এক ফোনে তুমুল দুর্ভোগে পড়েছেন ঝুমাদেবী। তার হিসেবে, ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার ফোন এসেছে মোবাইলে। শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর থেকেও এসেছে প্রশ্ন। ছাদে কি ভূত আছে? বাড়িওয়ালা ঠেলে ফেলে দেবে? পাইপ বেয়ে উঠতে হয় নাকি? বিজ্ঞাপনদাতাকে এক বার দেখতে চাই! ঝুমার অভিযোগ, ‘ছাদে কাপড় মেলতে সাহসী মহিলা কেন প্রয়োজন তা নিয়ে বেশিরভাগ প্রশ্নেই রয়েছে কুৎসিত ইঙ্গিত।’ ঝুমাদেবী জানিয়েছেন, বাধ্য হয়ে অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোন তিনি ধরছেন না।

কর্মসূত্রে আগে জাপানে থাকতেন। ২০১১ সালে ফেরেন কলকাতায়। স্বামী অধ্যাপক। তিনি নিজে বাংলা সিরিয়ালে অভিনয় করেন। যাদবপুরের সেন্ট্রাল রোডে একটি বহুতলের দোতলায় ফ্ল্যাট কেনেন তারা। তাদের ফ্ল্যাটের উপরের দু’টি তলায় থাকেন জমি-মালিক অমর রায়দের পরিবার। ঝুমাদেবীর অভিযোগ, ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই বিভিন্নভাবে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। কমন প্যাসেজে নিয়ম ভেঙে লোহার গ্রিল বসিয়ে দেওয়া, পাম্প চালানোর ঘরে আবর্জনা ভরে রাখা। শুধু তা-ই নয়, ছাদে জামাকাপড় তুলতে গিয়ে পোষ্য কুকুরের কামড়ও খেয়েছেন ঝুমাদেবী। ওই ফ্ল্যাটে চার জন কাজের লোক আছেন। তাই পাঁচ জন ‘সাহসী মহিলা’ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন বলে ঝুমার দাবি।

এ সব অভিযোগ উড়িয়ে অমরবাবুর পাল্টা দাবি, ‘এগুলো আমার পরিবারের বিরুদ্ধে অপবাদ।’

আপাতত অবশ্য লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষের ঠেলাতেই এখন নাকাল ঝুমাদেবী।

বিচিত্র ঘটনা নজরে এলেই সাত-পাঁচ না ভেবে ছড়িয়ে দেওয়ার এই হুজুগে মাস তিনেক আগে ভুগেছিলেন কলকাতার মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ। হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো একটি ছবিতে দেখা গিয়েছিল মেট্রোর চালকের আসনে এক মহিলা বসে। পাশে লেখা, কলকাতা মেট্রো রেলের প্রথম মহিলা চালক। হাজার হাজার লোকে ফেসবুকে শেয়ার করে কুর্নিশ জানাতে থাকে ওই অচেনা নারীকে। সংবাদমাধ্যমের কাছে খবর পেয়ে শেষমেশ মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁদের দফতরে কোনও মহিলা চালকই নেই। সম্প্রতি দিল্লির একটি স্কুল সম্বন্ধে রটে গিয়েছিল, সেখানে শাস্তিস্বরূপ দু’টি বাচ্চাকে আটকে রাখা হয়েছে। অভিভাবকেরা জড়ো হয়ে দেখেন তার পুরোটাই ভুয়ো। তেমনই কলকাতারই একটি থানায় একটি শিশু উদ্ধার হয়েছে বলে ফেসবুকে পোস্ট আসে। জনতার নিরন্তর প্রশ্নে নাকাল সেই থানা অবশ্য জানিয়েছিল এমন কোনও ঘটনা সেখানে ঘটেনি।

এ তো গেল ভুয়ো খবরে বিভ্রান্তি। প্রকৃত খবরও তার ‘চরিত্রগুণে’ এমনই ভাইরাল হয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। পুরনো জিনিস কেনাবেচার সাইটে বারাণসীর গৌরব সিংহ রাজপুতের ‘সপুত্র গরু’ বিক্রির বিজ্ঞাপন, বেরাল সিংহ নামক ব্যক্তির ১ লাখ ৮০ হাজারে চালক-সহ অটো বিক্রির বিজ্ঞাপন, বিদেশে চলে যাবেন বলে কর্নাটকের এক ব্যক্তির ২৫ টাকায় নিজের ব্যবহৃত টুথব্রাশ ও পেস্ট বিক্রির বিজ্ঞাপন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে হু হু করে। তালিকায় আছে আস্ত ছবির চিত্রনাট্যের বিজ্ঞাপনও! বিক্রেতা তার দাম ধার্য করেছিলেন ৪০ হাজার টাকা।

কেবল পণ্যই নয়। জীবনসঙ্গী খোঁজার বিজ্ঞাপনেও ‘অদ্ভুত’ চাহিদা দেখে ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দিয়েছে জনতা। তার মধ্যে রয়েছে ফেসবুক ব্যবহার করেন না, এমন পাত্রীর খোঁজ। পাত্রীরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? ছাব্বিশ বছরের ‘ফান-লাভিং’ পাত্রী বিজ্ঞাপনে জানিয়ে দিয়েছিলেন পাত্র ‘মায়ের ন্যাওটা খোকা’ হলে চলবে না।

খুচরো খোরাকের প্রতি এই অমোঘ আকর্ষণ যেন আমজনতার মজ্জাগত। ‘পথের কাঁটা’ উপন্যাসে বিজ্ঞাপন দেখেই ব্যোমকেশ বলেছিল, আসল খবর থাকে বিজ্ঞাপনে। মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, ‘অদ্ভুত’ কিছু নজরে এলেই তা লোকজনকে জানানোটা মানুষের প্রবণতা।

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী। তাই নিজে কৌতূহল নিরসনে যেমন তৎপর হয়, তেমনই অন্যকে জানাতেও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। এই প্রবণতা বরাবরই ছিল। সোশ্যাল মিডিয়া সেই অনুভূতি প্রকাশের মঞ্চটা আরও পোক্ত করে দিয়েছে।’ সোশ্যাল মিডিয়া পূর্ববর্তী যুগে নব্বইয়ের দশকে যেমন হ্যাপা পুইয়েছিলেন ২৪৪১১৩৯ ফোন নম্বরের মালিক। ‘বেলা বোস’ গানটি জনপ্রিয় হতেই বহু মানুষ বেলা বোসের খোঁজে বারবার ফোন করতেন সেই নম্বরে।

আজকের দিনে ভাইরাল কৌতূহলের অত্যাচার এড়াতে উপায় কী? অনুত্তমা বলছেন, ‘যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, তাদেরও সেই বয়ান সম্বন্ধে খানিক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তেমনই ব্যক্তিগত ফোন নম্বর না দিলে এমন অসুবিধে এড়ানো যেতে পারে।’ আর কৌতূহলীদের প্রতি তাঁর বার্তা, ‘অন্যের সুবিধে-অসুবিধের কথা ভেবে আত্মসংযমটা খুব প্রয়োজন।’

ঝুমাদেবীও রয়েছেন সেটারই অপেক্ষায়। তার খেদোক্তি, ‘লোক পাই বা না পাই, দেশ-বিদেশের ফোন আসাটা বন্ধ হলেই বাঁচি!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *