দিন যতোই যাচ্ছে আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী ক্রমেই যেন একেবারে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। মূলত: যারা এখানে নিরুপায় হয়ে একমাত্র জীবিকার টানে বসবাস করছে, কেবল মাত্র তারাই সহজে অনুমান করতে পারছে এর অসহনীয় যন্ত্রণা ও এর ভয়াবহ বিভীষিকা রূপ। এ প্রসঙ্গটি লিখতে গিয়ে ছোটবেলার একটি গল্পের কথা আজ বিশেষ করে মনে পরে গেল- ‘গ্রাম থেকে এক নাতি তার দাদাকে ঢাকাশহর ঘুরে দেখাতে নিয়ে এসেছে। দাদা ঢাকা শহর ঘুরতে এসে রাস্তায় হাজারো গাড়ীঘোড়ার যানজট ও লোকজনের কোলাহল দেখে নাতিকে বলছে হাটের দিনে কেন তোরা আমাকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে এলি যেদিন হাট থাকবে না সেদিন বেড়াতে নিয়ে আসবি’। দাদার চোখে দেখা সেই হাট এখানে যেন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যা এখানকার মানুষগুলোকে প্রাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত করছে। মূলত সীমিত আয়তন ও জনসংখ্যার ব্যাপকতার কারণে আমাদের এই ঢাকা শহর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে ইতিমধ্যেই ঘন জনবসতিপূর্ণ ও নিকৃষ্টতম অঞ্চল হিসেবে পরিগনিত হয়েছে। বিগত ২০০৩ সালের জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকা শহরকে বিশ্বের ১১তম মেগাসিটি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সমপ্রতি বিখ্যাত দ্যা ইকোনমিস্টের ইনটেলিজেন্সের এর তথ্যমতে, বিশ্বের ১৪০টি নিকৃষ্টতম বসবাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার স্থান দ্বিতীয়। অন্য অপর এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দ্যা মারকারস এক জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২২১টি বসবাস অনুপযোগী নিকৃষ্টতম শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২০৬তম। যা সত্যি নগরীতে বসবাসকৃত সকল নাগরিক ও পরিবেশবিদদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বর্তমানে ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেকেই ভীষণ শঙ্কা প্রকাশ করেছে। যদিও এর নেপথ্যে কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, দেশের পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় জনসংখ্যার বিশাল চাপ প্রতিদিনই এখানে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে ফলে চাহিদানুযায়ী এখানকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো রক্ষা করা মূলত কঠিন হয়ে পরেছে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, প্রশাসনিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণ, ছোট ও মাঝারি শহরগুলোর উন্নয়ন এবং সকলে মিলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা রোধ করতে পারলে ঢাকার বর্তমান সঙ্কটময় অবস্থার হাত থেকে নগরবাসীকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব হবে।
Read More News
মূলত: ঢাকা দেশের রাজধানী ও প্রাণকেন্দ্র এবং সকল ধরনের অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে এখানে টেনে আনা হয়েছে যা ফলে নগরীতে প্রাপ্ত নাগরিক সুবিধাগুলো ব্যাহত হচ্ছে এবং তা ক্রমেই যেন ভয়াবহ ও তীব্র আকার ধারণ করছে। নগরীতে যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা, সুশাসন, উন্নয়নমূলক কাজে অর্থ জালিয়াতি, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষবাণিজ্য ও ভয়াবহ দূর্নীতির কারণে এখানকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিকারের বিপরীতে সমস্যার এই ধারাবাহিকতা যেন তা ক্রমেই গুরুতর আকার ধারণ করছে। এখনি যদি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে আগামি বছরগুলোতে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরসহ এর আশেপাশের শহরগুলো সত্যিই স্থবির হয়ে পড়বে ও নগরবাসীর উপর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই পরিস্থিতি আরো বেগবান ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করার আগেই সংশ্লিষ্টদের এই ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এটাই কামনা করি। যা নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা দ্রুত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে আগ্রহী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেহেতু সরকারের একার পক্ষে দীর্ঘ দিনের সঞ্চিত এ ধরনের হাজারো সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়, সেহেতু সম্মিলিত ভাবে ৪০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যময় ও গৌরবময় ঢাকাকে বাঁচাতে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা, সিটি করপোরেশন ও সকল নাগরিকদেরকে এগিয়ে আসবে হবে এবং ঢাকায় অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। আসছে আগামি ১১ জুলাই আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা দিবসকে সামনে রেখে ঢাকার বিশাল জনসংখ্যা রোধে প্রতিটি নাগরিকদেরকে বিশেষ অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। বিশেষ করে আমাদের দেশের যুবসমাজকে এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে দেড় কোটি মানুষের বাসস্থান ঢাকা নগরীতে প্রতিদিন আরো অতিরিক্ত যোগ হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসা হাজার খেটে খাওয়া মানুষ যা নগরীর জনসংখ্যার চাপকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। জনগণের ভয়াবহ চাপ, রাস্তায় ফিটনেজবিহীন অবৈধ্য অধিক যানবাহন এবং এর দ্বারা সৃষ্ট ভয়াবহ যানজট ও শব্দদূষণ নগরবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও প্রতিনিয়ত অসহনীয় যানজট নগরী ও এর আশেপাশের এলাকাকে ক্রমশই ক্যান্সারের মতো গ্রাস করছে। যার অসহনীয় যন্ত্রণা প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নগরবাসীকে সহ্য করতে হচ্ছে। যানবাহনের দূর্ষিত ধোঁয়া, কারখানার বর্জ্য ও গ্যাসে নগরীর স্বাভাবিক পরিবেশ যেমন ভয়াবহ বিপর্যস্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি এখানকার বাসিন্দারাও মারাত্মক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারি ছুটির দিন বা অন্য যেকোনো দিন হোক অধিক যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোও একেবারে অসম্ভব হয়ে পরেছে। কখন কখন গন্তব্যে পৌঁছাতে নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে ২/৩ ঘণ্টা সময় অধিক ব্যয় হচ্ছে। এমন দৃশ্য নগরীতে প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে মহানগরীতে ভয়াবহ যানজটের কারণে একদিকে যেমন আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, ঠিক তেমনি সুষ্ঠু নাগরিক ব্যবস্থা চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। তথ্য মতে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিবছর প্রায় দেড় থেকে দুই শত কোটি টাকার মতো আর্থিক অপচয় হচ্ছে। নগরীতে এই অসহনিয় যানজট নিরশন ও নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাপন ফিরিয়ে দিতে পারলে ঐ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে। অপরিকল্পিতভাবে ক্রমাগত শহর সমপ্রসারণ ও শিল্পায়নের ফলে নগরীর পরিবেশে যেমন দূর্ষিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি পরিবেশের মাঝে দারুণ ভারসাম্যহীনতা ও অবক্ষয় ঘটছে। অত্যাধিক জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও নিম্নমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, অধিক শিল্প কলকারখানা স্থাপন, অধিক বাসস্থান নির্মাণ, প্রভূতি কারণে মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণসহ নানা কারণে পরিবেশগত সমস্যা এখানে দিনদিন জটিল আকার ধারণ করছে। রাস্তার পাশে আবাসিক, অনাবাসিক, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ভয়াবহ শব্দ দূষণের স্বীকার হচ্ছে। রাস্তায় অধিক যানজট ও অহেতুন হর্ণ বাজানোর ফলে শব্দদূষণের তীব্রতা এখানে প্রতিনিয়তই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। আবাসিক এলাকায় শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন ব্যবস্থা ও রাস্তায় চলাফেরায় নিরাপত্তা না থাকায় আমাদের সন্তানেরা একপ্রকার বধ্যঘরে ব্রয়লার মুরগির মতো বেড়ে উঠছে, যা সত্যিই কষ্ট ও বেদনাদায়ক। অন্যদিকে নগরীতে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এখানে বাসস্থান সমস্যা দিনদিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাড়ি ভাড়ার চাহিদা থাকার কারণে নগরীতে একপ্রকার পাল্লা দিয়ে নিয়মবর্হিভূতভাবে ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে আর এই ধরনের ভবন শহরকে মৃত্যুপূরীতে পরিণত করছে। বর্তমানে নগরীর বাড়িওয়ালাদের দৌরোত্ম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নীতিমালা তোয়াক্কা না করে যে যেমন খুশি বাড়ি ভাড়া হাক্কাছে এতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ভাড়াটিয়াদের বেশি ভাড়া দিয়ে ঐ বাড়িতে বসবাস করতে হচ্ছে। নগরীতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও সঙ্কটের কারণে পরিত্যক্ত সরকারি রাস্তা, রেলওয়ের জমি, অব্যবহৃত প্রতিষ্ঠান, বাসস্ট্যান্ড, কাঁচাবাজার এবং নিম্নমানের বস্তিতে নিম্নআয়ের বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা দিনদিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা এইসব অবৈধ্য ও নিম্নমানের বস্তিতে অধিক অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে যা নগরীর পরিবেশকে কুলষিত করছে। মূলত নগর দারিদ্র্যতা, বস্তি ও নিম্নমানের এলাকায় বসবাসকৃত মানুষগুলোর সুষ্ঠু মানবিক বিকাশে ব্যাঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সামাজিক বৈষম্য যা নগরীতে অপরাধের মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে নগরীতে অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক অপরাধ, সামাজিক অপকর্ম যেমন- চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকব্যবসায়ী, চোরাচালান, যৌন ব্যবসা, রাস্তার গাড়ি ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ মতো ঘটনা হরহামেসা দেখা যাচ্ছে। যা নগরবাসীদেরকে দিনদিন আরো অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক করে তুলছে।
কিন্তু ইহা দুঃখজনক হলোও সত্য এদেশে কোনো সরকারই নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো বাস্তবায়নে তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। তারা সর্বদা নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে যেন অধিক ব্যস্ত থেকেছে, ফলে তাদের দ্বারা এ সমাজে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো বাস্তবায় বারবারই উপেক্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, যতদ্রুত সম্ভব সমস্যা সমাধানে সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে ঢাকা শহরের ওপর থেকে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ কমিয়ে আনতে ছোট ও মাঝারি শহরগুলোকে দ্রুত উন্নয়নের আওতায় আনা এবং সেই মর্মে কাজ করা। কেননা বড় শহরের তুলনায় ছোট ও মাঝারি শহরগুলোতে দূষণ কম ও বসবাস উপযোগী। অন্যদিকে অবকাঠামোগত ব্যয়, জীবনযাত্রার মান শহরের চেয়ে ছোট ও মাঝারি শহরগুলোতে কম তাই যতোদ্রুত সম্ভব ঢাকায় সরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করে নগরীর জনগণের চাপ কমিয়ে আনা জরুরী বলে মনে করি। তবে ঐ বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হয় সেইদিকটাও লক্ষ্য রাখা জরুরি। কেননা বর্তমান সরকার যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভাজন করেছে এর সুফল এখন পর্যন্ত নগরীর জনগণ ভোগ করতে পারেনি। বিপরীতে সেবা পেতে নগরবাসীদেরকে নতুন ও পুরনো সিটি করপোরেশন অফিসে ছুটোছুটি ও কার্যসম্পূর্ণ করতে প্রতিনিয়ত হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে। যা সেবার চেয়ে কষ্টের মাত্রাই যেন আরো অধিক বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো আমাদের কাছে অধিক লক্ষ্যণীয় তা হচ্ছে, সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি বিন্যাসে ত্রুটি, দুইভাগে বিভক্ত ডিসিসির নতুন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জটিলতা, সেবাপ্রদানে বৈষম্য, জনবল ও সম্পত্তি নিয়ে বৈষম্য, প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা, রাজস্ব আদায়ে ভারসাম্যহীনতা যা নাগরিক সেবার নামে বৈষম্য মাত্রাকে আরো অধিক গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে ঐ বিষয়গুলোর দিকে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের অধিক মনোনিবেশ করাকে জরুরি বলে মনে করি। যদি আমরা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক উৎপাদন বৈশিষ্টতা এবং সামাজিক প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে ছোট ও মাঝারি শহরগুলো উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ করতে পারি তবে কিছুটা হলেও নগরায়নজনিত নাগরিক ভারসাম্যহীনতার সমস্যা কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে স্বাধীন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকরীকরণ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীয়করণ সেইসঙ্গে গ্রামোন্নয়নের অধিক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক হারে শহরমুখী জনগোষ্ঠীকে নিরুৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাকেও এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করি। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ছোট ও মাঝারি শহরগুলো উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ, গ্রামীণ কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপন, শিক্ষা বিস্তার, সুদবিহীন ক্ষুদ্র ঋণের প্রসার, খাল-বিল খনন, বৃক্ষরোপণ, মৎস্য ও গবাধি পশু পালনের মতো কর্মসূচি অধিক গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের পদ সৃষ্টি ও আকর্ষণীয় মজুরি প্রদান করতে সক্ষম হই সেইসঙ্গে অধিক জনসংখ্যা রোধে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারি তবে কিছুটা হলেও নগরবাসীর অসহনীয় যন্ত্রণা লাঘব হবে বলে আশা করি।
বিশেষ করে নগরীতে প্রতিনিয়তই ভয়াবহ যানজট, অপরিকল্পিত ও সংকীর্ণ রাস্তাঘাট, যেখানে সেখানে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ, দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা যেখানে- সেখানে জায়গা দখল করে যত্রতত্র অনুমোদনহীন স্থাপনা তৈরি, ভূমি দস্যুদের অপতৎপরতা, বাড়িওয়ালাদের দৌরোত্ম্য বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দারুণ সঙ্কট, নাজুক পয়োনিষ্কাশন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পানি নিষ্কাশন পথে ময়লা আবর্জনা স্তূপ তৈরি করে পানির প্রভাবে বাঁধা সৃষ্টি করা, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট করে অবৈধ ভবন নির্মাণ, পবিবেশ রক্ষার ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞানের স্বল্পতা, নগরীতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা, অসচেতনতা, অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক কার্যকলাপসহ বহুবিধ কারণে নাগরিক জনগণ যেন গোড় সঙ্কটে নিমর্জ্জিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় প্রতিকারে সংশ্লিষ্টদের তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়গুলো আমাদের নজরে পরছে না। যদিও সমপ্রতিকালে নগরীর জনদুভর্োগ নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্র-পত্রিকায় ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিস্তার লেখালেখি ও ভিডিও ফুটেজ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সমস্যা সমাধানের বিপরীতে তারা নিজেদের দোষ অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টায় যেন অধিক ব্যস্ত আছে। ফলে সঙ্কটগুলো সমাধানের বিপরীতে তা আরো তীব্র আকার ধারণ করছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই নগরীর বাসা-বাড়িতে প্রয়োজনীয় গ্যাস ও পানির সঙ্কট স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘি্নত করছে। পানির সঙ্কটের কারণে নগরবাসীকে পানির জন্য প্রায় সময়ই দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, সেইসঙ্গে জগ ও বালতি নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছে। নগরীতে পানি সঙ্কটের এমন দৃশ্য হরহামেশাই নগরবাসীকে দেখতে হচ্ছে। যা নাগরিক জীবনযাত্রার মানকে আরো অসহনীয় করে তুলছে। এক্ষেত্রে পানি সমস্যা কিছুটা সমাধানের জন্য ওয়াসায় পানি নিতে চাইলেও সেখানে ঘটছে না ধরনের বিড়াম্বনা। অভিযোগ আছে ঘুষ না দিয়ে পানির চাহিদাপত্র জমা দিলে দুই-তিন দিন অপেক্ষা করেও ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির গাড়ির সঞ্চান পাওয়া যায় না। অপর দিকে নগরীতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের দারুণ সঙ্কটতো রয়েছেই। চাহিদানুযায়ী বিদ্যুত না থাকায় শিল্প-কলকারখানায় যেমন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ঠিক তেমনি সাংসারিক দৈনন্দিন কাজকর্ম ও সন্তানদের লেখাপড়াও চরমভাবে বিঘি্নত হচ্ছে। ঘণ্টায় ঘন্টায় লোডশেডিং এবং গ্রীষ্মের প্রচ- গরমে নরগবাসী এক প্রকার দিশেহারা হয়ে পড়ছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ত ও ক্রান্ত মানুষগুলো অফিস থেকে বাড়ি ফিরে পানি ও বিদ্যুতের অভাবে ঠিক মতো গোসল ও রাত্রীযাপন করতে পারছে না। আবার অন্যদিকে বর্ষায় অবিরাম বৃষ্টিপাতে নগরজীবনে কিছুটা শান্তি ফিরে এলেও যথাযথ পানি নিষ্কাশনের অভাবে নগরী ও এর আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়িতে পানি জমে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাটের সংস্কারমূলক কাজে অধিক খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও নগরবাসীদের চরম দুভর্োগ পোহাতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় এলাকাগুলোতে সুপেয় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে পানিতে ভাসমান ময়লা আবর্জনা ও দুর্ষিত পানি খেয়ে পানিবাহিত নানাবিধ রোগব্যাধিতে নগরবাসী আক্রান্ত হচ্ছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতা নগরীর যানজটকে আরো অধিক জট পাকিয়ে ফেলছে। ফলশ্রুতিতে নগরী ও এর আশপাশের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও চলাফেরা চরম ভাবে বিঘি্নত হচ্ছে এবং তাদেরকে একেবারে নাজেহাল করে ফেলছে। প্রতিনিয়ত এরূপ হাজারো সমস্যা নগরীতে বসবাসকৃত মানুষগুলিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে থমকে দিচ্ছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সম্বনয়হীনতার কারণে এর সুফল থেকে নগরবাসী বরাবরই হয়েছে বঞ্চিত। এক্ষেত্রে যে দৃশ্যগুলি প্রতিনিয়ত নগরবাসীকে দেখতে হয়েছে, এক প্রতিষ্ঠান রাস্তা মেরামত করার পরের মাসে আরেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উক্ত রাস্তা আবার খোড়াঁ-খুঁড়ি করা হচ্ছে। ফলে মেরামতকৃত রাস্তায় সুষ্ঠু চলাচলের বিপরীতে আরো জনদুভর্োগ বেড়েছে। যদিও বর্তমান সরকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু উন্নয়নমূলক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় লেজুরবৃত্তি ও সুযোগসন্ধানীদের অপ-তৎপরতা, অনৈতিকতা, অধিক দুর্নীতি সরকারের গৃহিত বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং নগরবাসীর কাছে সরকারের সাফল্যকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ঐ বিষয়গুলো শক্ত হাতে প্রতিহত করা এবং কার্য দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা। যদিও আমাদের দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতাশীল দলগুলোর দলীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের একটি বিশেষ রীতির প্রচলন আছে। যার সুফল ভোগ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। তাই এক্ষেত্রে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে তখন তাদের উচিত হবে দলীয় বিবেচনায় যদি কেউ কোনো কাজ পায় তবে ঐ প্রতিষ্ঠানটি কাজগুলো যথাযথ ও কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক কাজ যথাযথ করছে কিনা সেদিকে অধিক নজর দেয়া একই সঙ্গে ঐ প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। এতে যেমন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, ঠিক তেমনি দেশ ও জাতি অধিক উপকৃত হবে।
ইতিমধ্যে বর্তমান সরকার চাহিদা অনুযায়ী নগরীতে অধিক ব্রিজ, ফ্ল্যাইওভার ও সড়ক নির্মাণে জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমির মালিকানা স্বত্ব ও জমি হস্তান্তরের জটিলতা পরিহার, নগরীয় জমির অনিয়ন্ত্রিত তথ্যের অভাব পরিহার, নগরীয় খাসজমির সার্বিক হিসাব ও তার রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিতকরণ, প্রভূতি বিষয় ভূমি ব্যবস্থাপনার নীতির আওতায় এনেছে যা ইতিবাচক বলে মনে করি। নগরীতে অসহনীয় যানজট নিরসন ও জনদুভোর্গ রোধে সরকার নগরীর বিভিন্ন সড়ক, রেলযোগাযোগ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার মানন্নোয়নে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে নগরীতে আধুনিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে তা ইতিবাচক। সরকারের অগ্রগতির এই ধারা অব্যাহত থাকলে নগরীর অসহনীয় যানজট থেকে নগরবাসী কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে বলে মনে করি। আমরা আশা করবো সরকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে আরো অধিক বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং নগরবাসীকে ভয়াবহ সঙ্কট থেকে স্থায়ী মুক্তি দেবেন। তবে ইহা বাস্তবায়নে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না যারযার জায়গা থেকে একে অপরকে কোনো দোষারোপ না করে সম্মিলিতভাবে সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে। কেননা সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছাই পারে একটি সুন্দর ও বসবাসযোগ্য ঢাকা এ জাতিকে উপহার দিতে। এক্ষেত্রে সকলের অধিক সদিচ্ছা বিশেষভাবে কামনা করি।