প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করে আসার পর রাত ক’টায় ঘুমিয়েছেন, ঠিক বলতে পারলেন না তামিম ইকবাল। স্বভাবতই কাল সকাল এগারোটাতেও টেলিফোনের ও-প্রান্তে সেঞ্চুরিয়ানের কণ্ঠস্বর ঘুম জড়ানো। তবে তাতেও আনন্দের রেশ মিশে। সাইদুজ্জামান-এর নেওয়া সাক্ষাত্কারে জেগে উঠলেন সেই তামিমও, যিনি গত কিছুদিন হলো ক্রমাগত প্রস্ফুটিত হচ্ছেন, যা বহু আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল তাঁর কাছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অতৃপ্তিটা তামিমেরও ছিল।
প্রশ্ন : সেঞ্চুরি তো আগেও অনেক করেছেন। কিন্তু ২০১০ সালে লর্ডসের পর ধর্মশালায় সেঞ্চুরির পরই ওভাবে লাফালেন। উদ্যাপনে এ বিশেষত্বের কারণ কী?
Read More News
তামিম ইকবাল : লর্ডসে কোনো বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলাম, কাল (পরশু) টি-টোয়েন্টির প্রথম বাংলাদেশি সেঞ্চুরিয়ান হওয়ার আনন্দেই লাফটা দিয়েছিলাম। বিশেষ কিছু করতে পারলে তো সব মানুষই খুশি হয়।
প্রশ্ন : কিন্তু সেঞ্চুরির আগেই তো ক্র্যাম্পের মতো হয়েছিল, যদি ওই লাফটা দিয়ে চোট পেতেন?
তামিম : (হাসি) খুব খুশির সময় কি আর অত কিছু মনে থাকে! তবে খেয়াল করে দেখবেন লাফটা অত জোরে দেইনি, সতর্ক ছিলাম।
প্রশ্ন : মাথায় হাত দিয়ে কোচকে ইঙ্গিত করেছেন বুঝলাম। কিন্তু একটু পরই দেখলাম কড়ে আঙুল দেখাচ্ছেন। ওটা কার উদ্দেশে?
তামিম : মাই লিটল ওয়ান। আমার ছেলের জন্য।
প্রশ্ন : সেঞ্চুরিটা নবজাতককে উত্সর্গ করারই কথা। সে মুহূর্তে আর কাউকে মনে পড়েনি?
তামিম : পড়েছে, তবে তালিকাটা বিশাল। প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমার বাবাকে (প্রয়াত ইকবাল খান) মনে পড়ে। আজ আমি যা, ভবিষ্যতে যা-ই হই না কেন তা আমার বাবার জন্য। উনি আমার সব কিছু। আমার মা-ভাইও আমার জন্য কম করেননি। আমার স্ত্রী খেলাটেলা বোঝে না। কিন্তু আমি জানি ও আমার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করে, সব সময় পাশে থাকে। আমি জানি ওরা সবাই আজকে কত্ত খুশি। গর্ববোধ করছে। আমার জন্য কাছের প্রত্যেকটা মানুষ গর্ববোধ করছে, জীবনে এর চেয়ে ভালো লাগার আর কী আছে বলুন!
প্রশ্ন : টিম কিভাবে সেলিব্রেট করল আপনার এই সেঞ্চুরি?
তামিম : একেবারে অন্য রকমভাবে। খুব স্পেশাল কিছু না, তবে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিয়ে যখন ড্রেসিংরুমে ঢুকছি, তখন সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে আমাকে বরণ করে নিয়েছে। খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম!
প্রশ্ন : কোচ কিছু বলেননি?
তামিম : না, আমরা সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম হোটেলে ফেরার জন্য।
প্রশ্ন : এক মাসও হয়নি ছেলের, সেও তো কিছুই বলতে পারেনি, বোঝেওনি নিশ্চয়!
তামিম : (হাসি) না, ওর মা ভিডিও পাঠিয়েছে, সেটা দেখেছি। এখন ছোট হলে কী হবে, একদিন তো বড় হবে। সেদিন জানবে বাবা কিছু একটা করেছিল।
প্রশ্ন : শুধু আপনার পরিবার কেন, পুরো দেশই তো আজকে আপনার জন্য গর্বিত। এমনকি ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় যাঁরা আপনার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরাও আজ অনুতপ্ত।
তামিম : আমরা খেলি দেশের জার্সি গায়ে। তাই তাদের হাসি-কান্নার উপলক্ষও হয় আমাদের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা। নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ই জীবন বাজি রেখে মাঠে নামে, কখনো সফল হয় কখনো হয় না। আমিও এর বাইরে নই। দূর ধর্মশালায় বসেও অনুমান করতে পারি দেশের মানুষ কতটা খুশি। তো, জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে দেশের মানুষকে আনন্দ দিতে পেরে অবশ্যই দারুণ লাগছে। আর আপনি যে কথাটা বললেন, ২০১৫ সালের সমালোচকরা এখন অনুতপ্ত শুনে ভালো লাগছে (হাসি)। আসলে ওসব দিন নিয়ে আর আগের মতো ভাবি না। প্রতিক্রিয়া হয় না।
প্রশ্ন : বলেন কী? ওইরকম একেকটা ট্রল ভুলে গেলেন, যেখানে আপনার পরিবারকেও আক্রমণ করা হয়েছিল!
তামিম : সত্যিই ভুলে গেছি। ভুলে যাওয়াই কি ভালো নয়? ধন্যবাদ মাশরাফি ভাইকে। উনি আমার মেন্টর। আগে সমালোচনা হলে খুব রিঅ্যাক্ট করতাম। উনিই আমাকে বুঝিয়েছেন সমালোচনা নিয়ে মাথা না ঘামাতে। এখন আর সমালোচনা গায়ে মাখি না। তাতে আমার উপকারই হয়েছে। নিজের ওপর বিশ্বাস রয়েছে, ভালো খেলার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টাই করি। কাল (পরশু) সফল হয়েছি, আরেক দিন হয়তো হব না। তবু নিজে যত দিন চেষ্টা করে যাব, তত দিন আমি তৃপ্ত থাকব।
প্রশ্ন : ২০১৫ প্রসঙ্গ যখন এলোই, তখন ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি সেঞ্চুরিয়ান না হতে পারার দুঃখটা তো মনে ফিরে আসার কথা!
তামিম : রিয়াদ (মাহমুদ উল্লাহ) ভাইকে আবারও অভিনন্দন ওই কীর্তির জন্য। কাল (পরশু) উনিই মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার পর বিশ্বকাপে করা দ্বিতীয় সেঞ্চুরির (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) ছবি দেখাচ্ছিলেন। কাকতালীয়ভাবে সেটা তিনি করেছিলেন ১৩ মার্চ। তবে হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগে কোচকে বলেছিলাম যে বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরিটা আমিই করব। মাত্র ৫ (স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫) রানের জন্য সেটা পারিনি। পরে কোচ বলেছিলেন, তুমি ওয়ার্ল্ড টি- টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরি করবে। সেটা করেও ফেললাম।
প্রশ্ন : বাংলাদেশও উঠে গেল শিরোপার আসল লড়াইয়ে। আপনার দিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতি মতো এরপর তো বাংলাদেশকে অচেনা মনে হওয়ার কথা!
তামিম : এখনো তাই বলছি। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের শুরুটা ভালো হয়ে গেলে অন্য বাংলাদেশকেই দেখবেন। এই ফরম্যাটে সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে যায়। তাই কী হবে, তা আগাম বলা মুশকিল। আর আমাদের দলটা যেভাবে চার্জড হয়ে আছে, তাতে আমি অনেক আশাবাদী। অবশ্য আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ ভাবি। আপাতত পাকিস্তান ম্যাচটা নিয়েই ভাবছি।
প্রশ্ন : আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে শুধু আপনিই না, পুরো দলই অনভ্যস্ত টি-টোয়েন্টির আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেছে!
তামিম : সে দাবি এখনো করছি না। তবে এটা ঠিক যে আমরা ভালো ক্রিকেট খেলছি, ড্রেসিংরুমের পরিকল্পনা মাঠেও বাস্তবায়ন করতে পারছি। রেজাল্ট পাচ্ছি এ কারণেই। তাতে আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেছে বহুগুণ।
প্রশ্ন : এই পরিকল্পনা মাঠে বাস্তবায়ন করতে পারা কতটা স্বস্তির কিংবা আনন্দের?
তামিম : দুটোই। ওমানের বিপক্ষে শুরুতে আটকে গিয়েছিলাম। যেই মাত্র ফাইন লেগে ঘুরিয়ে মারা শটটা লেগে গেল, সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যানমাফিক শট খেলতে পারার আনন্দে মনটা ভরে গেল। এরপর অনায়াসে খেলেছি। উদাহরণটা দিলাম এ কারণে যে প্ল্যান অনুযায়ী খেলতে পারলে পুরো দলই চার্জড আপ হয়ে যায়।
প্রশ্ন : লোয়ার অর্ডারে বিগ হিটার না থাকায় কোচ স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদেরই রান তোলার কাজটা করে দিতে বলেছেন। টপ ফোর রানও করছে। কিন্তু সব দিন তো আর এক রকম যায় না, সেরকম দিনে কী হবে?
তামিম : আপনারা ভুলে গেছেন আমাদের লোয়ার মিডল অর্ডারে মুশফিক-রিয়াদ ভাইয়ের মতো ব্যাটসম্যান আছেন। আমি নিশ্চিত তারাও অপেক্ষায় আছেন ওরকম দিনে জ্বলে ওঠার। আর আমরা কিন্তু বিগ হিটিংয়ে রান করছি না। ক্রিকেটীয় শটস খেলেই রান করছি।
প্রশ্ন : মাশরাফি বিন মর্তুজা তাঁর ফেসবুক পেজে পর পর দুদিন দুটি ছবি পোস্ট দিয়েছেন। একদিন আপনাদের সিনিয়রদের সঙ্গে, আরেক দিন জুনিয়রদের নিয়ে। এটা কি টিমকে এক সুতোয় গাঁথার ‘মাশরাফীয়’ পদ্ধতি?
তামিম : ছবি দেখে আপনারা হয়তো মনে করছেন এবারই এটা প্রথম হয়েছে। এটা হয়ে আসছে গত সাত-আট বছর ধরে। মাশরাফি ভাই এমন একজন মানুষ, যাঁর রুমে যখন তখন যাওয়া যায়। আপনার বাসায় হয়তো একটা রুম আছে, যেখানে আপনি যা খুশি তা-ই করতে পারেন। আমাদের কাছে মাশরাফি ভাইয়ের রুমটা তেমনই। কেউ হয়তো পানি ফেলে দিল, কেউ-বা গ্লাস ভেঙে ফেলল। কিন্তু চিন্তা নেই কারণ মাশরাফি ভাই রাগ করবেন না। কারো মন খারাপ কিংবা কথা বলার লোক নেই তো, চলো, মাশরাফি ভাইয়ের রুমে। ওমান ম্যাচের পরে যেমন উনি রাত দুটার দিকে হোটেলের করিডরে স্পিকারে জোরে গান বাজাতে শুরু করলেন। সেই গান শুনে এক-দুই করে আমরা অনেকেই হাজির ওনার রুমে। আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে রাত আরো বেড়েছে। আমাদের টিম বন্ডিংটা তাতে আরো গাঢ় হয়েছে।
প্রশ্ন : সাকিব আল হাসান দীর্ঘদিন খ্যাতির জগৎ শাসন করেছেন। মুশফিকুর রহিমের পর মাশরাফি এখন অবিসম্বাদিত নেতা। এখন সবাই আপনাকে নিয়ে মাতামাতি করছে। এটা কি বাংলাদেশের বড় দল হয়ে ওঠার লক্ষণ?
তামিম : তা তো অবশ্যই। সাকিব কিন্তু এক-দুই বছর না, বহুদিন ধরেই দলের টপ পারফরমার। মুশফিক, রিয়াদ ভাইরাও দুর্দান্ত খেলছেন। আমি ছাড়া দলের অনেক তরুণও ম্যাচ জেতানোর পারফরম্যান্স করেছে। একটা দলে যখন পারফরমারের সংখ্যা বাড়ে, তখন রেজাল্টও আসে। এখন যেমন আমরা পাচ্ছি।